রাজধানীর গোড়ান এলাকার মনোয়ারা খাতুন আট মাস বয়সী কন্যাসন্তানকে শাশুড়ির কাছে রেখে গুলিস্তানের স্টেডিয়াম মার্কেটে এসেছেন চার্জার ফ্যান কিনতে। গত বুধবার বিকেলে গুলিস্তানের দোকানে দোকানে ঘুরে চার্জার ফ্যান দেখছিলেন তিনি। কিন্তু পছন্দসই ফ্যান পাচ্ছিলেন না। মূলত শিশুসন্তানের জন্য কোন ধরনের চার্জার ফ্যান কিনলে ভালো হবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন এই গৃহিণী।
মনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘লোডশেডিং এতটাই বেড়েছে যে টেকা দায়। আমরা না হয় কষ্ট করে থাকতে পারি, কিন্তু ছোট বাচ্চাকে নিয়ে পড়েছি সমস্যায়। তার জন্যই বাধ্য হয়ে চার্জার ফ্যান কিনতে এলাম।’
বাস্তবতা হলো, রাজধানীর নিম্ন আয়ের মানুষ, যারা মূলত বস্তি বা বদ্ধ ঘরে বসবাস করেন, লোডশেডিংয়ের কারণে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা বা দিনের বেলায় বিদ্যুৎ চলে গেলে তাঁরা ঘরের বাইরে সময় কাটান। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে রাত ১২টার পরও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। তাঁদের অনেকের পক্ষে চার্জার ফ্যান কেনাও কঠিন। তাই রাতের বেলা ঠিকমতো ঘুমাতেও পারছেন না তাঁরা। দিনের বেলায় ঠিকঠাক কাজও করতে পারছেন না তাঁরা।
দেশজুড়ে লোডশেডিং এখন লাগামছাড়া। যাদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা চার্জার ফ্যান ও আইপিএস কিনছেন। ফলে এসবের বিক্রি আবার বেড়েছে। এর আগে চলতি বছরের জুলাই মাসে লোডশেডিং শুরু হলে এক দফা বৈদ্যুতিক পাখা, চার্জার ফ্যান, তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ যন্ত্র বা আইপিএসের বিক্রি বেড়েছিল। তখন দামও বেড়েছিল। এখন এসে আরেক দফা বেচাবিক্রি বেড়েছে চার্জার ফ্যান ও আইপিএসের দাম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সম্প্রতি বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় চার্জার ফ্যান ও আইপিএসের বিক্রি গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
গত বুধবার রাজধানীর গুলিস্তান স্টেডিয়াম মার্কেট, ফুলবাড়িয়া সুন্দরবন স্কয়ার সুপারমার্কেট ও নবাবপুরের ইলেকট্রনিক পণ্যের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা চার্জার ফ্যান ও আইপিএসের মতো পণ্যের বেচাকেনায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। নতুন করে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের এখন যেন দম ফেলারও ফুরসত নেই। বিশেষ করে চার্জার ফ্যানের বিক্রি সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ক্রেতারা চার্জার লাইট ও আইপিএসও কিনছেন বেশি।
রাজধানীর নবাবপুরের আলিম ইলেকট্রিকের স্বত্বাধিকারী আলিম মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় দিনে ৫৫ থেকে ৬০টি চার্জার ফ্যান বিক্রি হচ্ছে। গত বছর দিনে ৩০ থেকে ৩৫টা বিক্রি হতো। লোডশেডিংয়ের কারণে এ বছর ব্যবসা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তবে এটা মৌসুমি ব্যবসা। চার্জার ফ্যানের পাশাপাশি আইপিএসের ব্যবসাও ভালো।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে বাজারে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতিটি চার্জার ফ্যান বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন তিন হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ সাত হাজার টাকা। আর ব্যাটারির সক্ষমতা বিবেচনায় একেকটি আইপিএসের দাম ৮ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। গত ৪ মাসে প্রতিটি চার্জার ফ্যানের দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। বাজারে এখন ১২ ইঞ্চি মাপের একটি চার্জার ফ্যানের দাম ৩ হাজার টাকার বেশি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে এখন ১৪, ১৬ ও ১৮ ইঞ্চি চার্জার ফ্যানের চাহিদা বেশি। এসব ফ্যানের দাম সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আমদানি করা বড় স্ট্যান্ডের চার্জার ফ্যানের দাম ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৭ হাজার টাকা। চার্জার ফ্যানের মতো বাজারে আইপিএসেরও নানা ধরন আছে। তবে চাহিদা বেশি মাঝারি মানের ৮০০ থেকে ১২০০ ওয়াটের আইপিএসের। এসব আইপিএসের দাম ব্র্যান্ড ভেদে ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা।
বিক্রি বাড়লেও এখনকার বেচাকেনা গত জুলাই-আগস্ট মাসের মতো নয় বলে জানান বিক্রেতারা। তাঁরা বলছেন, এখন শীতের
মৌসুম চলে আসায় মানুষ এসব পণ্য কম কিনছেন। তবে অন্য বছর এ সময়ে চার্জার ফ্যান বলতে গেলে বিক্রিই হতো না। সেই বিবেচনায়
এবার বিক্রি ভালো। একদিকে চাহিদা বেড়েছে, অন্যদিকে বেড়েছে আমদানি খরচ। দুটি মিলে তাই চার্জার ফ্যানের দাম ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা বেড়েছে।
আমদানি করা চার্জার ফ্যানের পাশাপাশি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের তৈরি চার্জার ফ্যানও রয়েছে বাজারে। এসব ফ্যানের চাহিদাও বেশ ভালো। বাজারে রয়েছে দেশীয় কোম্পানি প্রাণ-আরএফএলের ভিশন ও ক্লিক ব্র্যান্ডের চার্জার ফ্যান। এসব ফ্যানের বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান বলেন, গরমের তীব্রতা ও বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে চার্জার ফ্যানের বিক্রি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি এখন। বর্তমানে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার চার্জার ফ্যান বিক্রি হচ্ছে। এ বিক্রি অন্যান্য বছরের চেয়ে তিন গুণ বেশি।
বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে সবাই যে চার্জার ফ্যান কিনছেন তা নয়, অনেকে পুরোনো চার্জার ফ্যান ঠিক করছেন। নরসিংদী থেকে ষাটোর্ধ্ব শফিকুর রহমান গত বুধবার রাজধানীর ফুলবাড়িয়ার সুন্দরবন স্কয়ার সুপার মার্কেটের নিচতলায় বসা ফ্যান মেরামতকারী কামাল আহমেদের কাছে এসেছিলেন পুরোনো ফ্যান মেরামত করতে। এ সময় আলাপকালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫০০ টাকা দিয়ে একটি ব্যাটারি আর ২০০ টাকা মজুরি দিয়ে পুরোনো চার্জার ফ্যানটি ঠিক করিয়ে নিলাম। দুই বছর তো অনায়াসে চলবে।’
বিদ্যুৎ-সংকট মোকাবিলায় দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় গত ১৮ জুলাই। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, ১৯ জুলাই থেকে দেশজুড়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং শুরু হয়। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অক্টোবর মাসে লোডশেডিং কমে যাবে। কিন্তু সেটি তো হয়নি, উল্টো বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে লোডশেডিং আরও বেড়েছে। প্রচণ্ড গরম, সেই সঙ্গে লোডশেডিং; দুটি মিলে মানুষের এখন নাকাল অবস্থা। আর তাতে চাহিদা বেড়েছে চার্জার ফ্যান ও আইপিএসের মতো পণ্যের।